Quantcast
Channel: - Radical Socialist
Viewing all articles
Browse latest Browse all 214

গ্রামশি এবং রুশ বিপ্লব

$
0
0

 

 

গ্রামশি এবং রুশ বিপ্লব

রুশ বিপ্লব নিয়ে তরুণ গ্রামশি কী ভেবেছিলেন?

-আলভারো বিয়াঞ্চি এবং ডানিয়েলা মুসি

দানিয়েলা মুসি সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পোস্ট-ডক্টরেট গবেষক এবং “Outubro” পত্রিকার সম্পাদক

আলভারো বিয়ান্সি স্টেট ইউনিভার্সিটি অব্‌ ক্যাম্পিয়ানস্‌-এর পলিটিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক। তিনি ‘ল্যাবোরেতোরিও দে গ্রামশি (আলামেদা, ২০০৮)’-র লেখক এবং “Blog Junho”-র সম্পাদক।

অনুবাদঃ প্রবুদ্ধ ঘোষ

সম্পাদনাঃ কুণাল চট্টোপাধ্যায়

জীবনের শেষ দশক ফ্যাসিস্ত কারাগারে রুদ্ধ হয়ে, আশি বছর আগের এই দিনেই মারা গেছিলেন আন্তোনিও গ্রামশি। গ্রামশির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার শুরু প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কালে, যখন তিনি তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ছিলেন। যদিও, তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অবদান ‘প্রিজন্‌ নোটবুকস্‌’-এর জন্যে তিনি বহু পরে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক লেখাগুলো যেগুলো সমাজতান্ত্রিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হত, সেগুলোতে শুধু মহাযুদ্ধের বিরোধিতাই করেননি উপরন্তু ইতালির উদারনৈতিক, জাতীয়বাদী এবং ক্যাথলিক সংস্কৃতিরও বিরোধিতা করেছিলেন

১৯১৭র শুরুতে গ্রামশি তুরিনের একটি সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা, ‘ইল গ্রিদো দেল পোপোলো [জনগণের চিৎকার]’-র সাংবাদিক ছিলেন এবং ‘আভান্তি [সম্মুখে]’ পত্রিকার পিদমন্ত সংস্করণে্র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের একমাস পরেও সেই খবর ইতালিতে রীতিমত দুষ্প্রাপ্য ছিল। তারা শুধুমাত্র ব্রিটেন ও ফ্রান্সের খবরের পুনর্প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু, ‘আভান্তি’তে রাশিয়ার বেশ কিছু খবর প্রকাশিত হত ‘জুনিয়র’ ছদ্মনামে, যাঁর আসল নাম ছিল ভাসিলিজ ভাসিলেভিচ সুকোমলিন। সুকোমলিন ছিলেন তৎকালীন রাশিয়া থেকে নির্বাসিত এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী।

ইতালিয়ান সমাজতান্ত্রিকদের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সরবরাহের উদ্দেশ্যে ইতালির সমাজতন্ত্রী পার্টি (পিএসআই)-এর নেতৃত্ব হেগ্‌ শহরে থাকা ডেপুটি ওদিনো মরগ্যারিকে নির্দেশ দেয় পেট্রোগ্রাড গিয়ে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে। কিন্তু, সে সফর ব্যর্থ হয় এবং মরগ্যারি ইতালিতে ফিরে আসেন জুলাই মাসে। ২০ এপ্রিলের ‘আভান্তি’তে গ্রামশির একটি নোট প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি মরগ্যারিকে ‘রেড আম্বাস্যাডার’ নাম দিয়ে তাঁর রুশযাত্রার কথা উল্লেখ করেন। রাশিয়ার চলমান ঘটনাসমূহের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ ছিল প্রবল। এসময় গ্রামশির মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ইতালির শ্রমিকবাহিনীর যুদ্ধের বিরোধিতা করার সম্ভাব্য শক্তি নিশ্চিতভাবেই রুশ প্রলেতারিয়েতদের শক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ্যভাবে সংযুক্ত। তিনি ভেবেছিলেন যে, রুশ বিপ্লবের সাফল্যের ফলাফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোর মূলগত বদল ঘটবে।

প্রথম মহাযুদ্ধ তখন তুঙ্গে এবং সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ যোগদানে ইতালির সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। গ্রামশির ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা যথা অ্যাঞ্জেলো তাস্কা, উমবের্তো তেরাসিনি এবং পালমিরো তোইলিয়াত্তি তখন যুদ্ধফ্রন্টে- কিন্তু, শারীরিক দুর্বলতার কারণে অব্যাহতি পেয়েছেন গ্রামশি। তাই, সাংবাদিকতাই তখন তাঁর একমাত্র ‘ফ্রন্ট’। ইতালিতে কোরিয়ে দেলা সেরা দ্বারা প্রকাশিত মরগ্যারিকে নিয়ে লেখাটিতে গ্রামশি যথার্থভাবে উদ্ধৃত করেছিলেন রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের। যেখানে সমস্ত ইউরোপীয় সরকারকে আহ্বান করা হয়েছিল আগ্রাসী নীতি প্রত্যাহার ক’রে শুধুমাত্র জার্মানির সমরাভিযানকে প্রতিরোধ করতে। আসলে, এই ‘বিপ্লবী রক্ষণাত্মক’ নীতিটি এপ্রিল মাসে সর্ব-রুশ সোভিয়েত সম্মেলনে বৃহত্তর অংশ দ্বারা সমর্থন পেয়েছিল। এই সম্মেলনের কয়েকদিন বাদেই এপ্রিলের ‘আভান্তি’ সংখ্যায় সম্মেলনের কর্তব্যসমূহের অনুবাদ প্রকাশিত হয় জুনিয়রের নামে।

রুশ বিপ্লবের কোনো টাটকা খবর রাশিয়া থেকে আসামাত্রই গ্রামশি সেগুলোকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করতেন। ১৯১৭-র এপ্রিলের শেষ দিকে ‘ইল গ্রিদো দেল্‌ পোপোলো’-তে ‘নোটে সুলা রিভোল্যুজুনেরুশা’ [রুশ বিপ্লব বিষয়ক টীকা] নামে গ্রামশির একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। যখন তৎকালীন অধিকাংশ সমাজতন্ত্রী রুশ বিপ্লবকে ‘নব ফরাসি বিপ্লব’ বলে অভিহিত করছেন, তখন গ্রামশি এর বিপরীত বিশ্লেষণ রাখেন সমাজতন্ত্রের অভিমুখে ‘সর্বহারার সক্রিয়তা’ বলে।

গ্রামশির চোখে রুশ বিপ্লব শুধুমাত্র জ্যাকোবিন মডেল অনুযায়ী ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ ছিল না বরং তার থেকে অনেক আলাদা। পেট্রোগ্রাডের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ ক’রে গ্রামশি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রকাশ করতে চাইছিলেন। আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং একে শ্রমিক বিপ্লবের দিশা দিতে রুশ সমাজতন্ত্রীদের জ্যাকোবিন মডেল ভাঙ্গতেই হবে- যে মডেল বলে নিয়মবদ্ধ সহিংসতা এবং কম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।

১৯১৭ সালের শেষ দিকে গ্রামশি ধীরে ধীরে নিজেকে একাত্ম ক’রে নিচ্ছিলেন বলশেভিকদের সঙ্গে; আর, তাঁর সেই অবস্থান ইতালির সোশ্যালিস্ট পার্টির যুদ্ধবিরোধী ও অপেক্ষাকৃত বেশি বিপ্লবী অংশের সমমনোভাবাপন্ন ছিল। ২৮শে জুলাই গ্রামশি একটি নিবন্ধ লেখেন “আই মাসিমালিস্তি রুশি (রুশি ম্যাক্সিম্যালিস্ত)” নামে, যেখানে তিনি পূর্ণ সমর্থন জানান লেনিন এবং ‘ম্যাক্সিম্যালিস্ট’ রাজনীতিকে। তাঁর মতে এটা ছিল, “বিপ্লবের ধারাবাহিকতা, বিপ্লবের ছন্দ এবং সেইজন্যেই পূর্ণ বিপ্লব।” ম্যাক্সিম্যালিস্টরা ছিল অতীতের প্রতি আনুগত্যহীন এবং ‘সমাজতন্ত্রের সীমাবদ্ধ ধারণার’ অবতারস্বরূপ।

গ্রামশি একান্তভাবে চেয়েছিলেন যাতে বিপ্লব কোনোভাবেই বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে বুর্জোয়া বিশ্বকে জয় করতে পারে। ‘ইল গ্রিদো দেল পোপোলো’-র সাংবাদিকের সমস্ত বিপ্লবের প্রতি, বিশেষতঃ রুশ বিপ্লবের প্রতি আশঙ্কার কারণ ছিল যে, বিপ্লবের এই প্রক্রিয়াটা যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ম্যাক্সিম্যালিস্টরা এই বিপ্লবপ্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘোরতর বিরোধী শক্তি বলেই তারা, “বিপ্লবপ্রক্রিয়ার শেষ যৌক্তিক যোগসূত্র” ছিল। গ্রামশির যুক্তিমতে, সমগ্র বিপ্লবপ্রক্রিয়াটাই সংযুক্ত এবং গতিমুখর ছিল; তাই সবচেয়ে শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসীরা সবচেয়ে দুর্বল এবং দ্বিধাদীর্ণদেরও অংশগ্রহণ করাতে পেরেছিল।

৫ই অগাস্ট সোভিয়েতের প্রতিনিধি দল তুরিনে পৌঁছায়, যার মধ্যে ছিলেন জোসিফ গোল্ডেনবার্গ ও আলেক্সান্দার স্মার্নভ। এই সফরের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল ইতালির সরকারের, কারণ তাদের আশা ছিল যে নতুন রুশ সরকারও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্মেলনের পরেও ইতালির সমাজতন্ত্রীদের দোলাচল ছিল সোভিয়েতের ব্যাপারে। ১১ই অগাস্ট ‘ইল গ্রিদো দেল পোপোলো’-র সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছিলেন,

‘যখন আমরা অবহিত হলাম যে, রুশ প্রতিনিধিরা যুদ্ধ চালানোকে সমর্থন করছে বিপ্লবের দোহাই দিয়ে, তখন আমরা জানতে উৎসুক হলাম- যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানে কি এই নয় যে, রাশিয়ায় সর্বহারার অগ্রগতির বিরুদ্ধে পুঁজিপতিদের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া?’

এ ছাড়া রুশ প্রতিনিধিদল আসায় বিপ্লবের প্রচার করার সুযোগ বাড়ে এবং এই সুযোগ কাজে লাগায় ইতালির সমাজতন্ত্রীরা। রোম, ফ্লোরেন্স, বোলোগান এবং মিলান ঘুরে প্রতিনিধিদল ফের তুরিনে আসে। দেল পোপোলোর অফিসের সামনে ৪০হাজার লোক অভ্যর্থনা করে তাদের; প্রথম মহাযুদ্ধের পরে এটাই ছিল প্রথম জনসমক্ষে অভিবাদন। বাড়ির বারান্দা থেকে প্রবল যুদ্ধবিরোধী এবং ম্যাক্সিম্যালিস্ট শাখার নেতা জ্যাচিন্তো মেনোত্তি সেরাত্তি রুশ প্রতিনিধি গোল্ডেনবার্গের ভাষণ অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন। রুশ প্রতিনিধি বলামাত্রই সেরাত্তি অনুবাদ করে ঘোষণা করলেন যে, রুশ বিপ্লবীরা যুদ্ধের তৎক্ষণাৎ অবসান চায় এবং অনুবাদ শেষ করলেন, “ইতালির বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” স্লোগান দিয়ে। উদ্বেলিত জনতাও সমস্বরে বলে উঠল, “রুশ বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক”, “লেনিন দীর্ঘজীবী হোন”।

‘ইল গ্রিদো দেল প্রোপোলো’-তে দারুণ উদ্দীপনা নিয়ে রুশদের সঙ্গে এই এই যৌথ মিছিলের কথা লিখলেন গ্রামশি। তাঁর মতে, এই মিছিল-সমাবেশ ছিল, “রুশ বিপ্লবের সংহতিতে সর্বহারা ও সমাজতন্ত্রীদের প্রকৃত অবস্থান।” কয়েকদিন বাদেই এই অবস্থান আরো স্পষ্টতর হল তুরিনের রাস্তায়।

২২শে অগাস্ট সকাল থেকেই তুরিনে রুটির সংকট প্রকট হলো, কারণ যুদ্ধের কারণে সমস্ত যোগান বন্ধ। দুপুর নাগাদ কারখানার শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দিলেন। বিকেল ৫টা নাগাদ সব কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। শহরের জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে বেকারি আর ওয়ারহাউসগুলো লুঠ করতে শুরু করল। কারোর নির্দেশে নয় কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফেটে পড়ল শহর। রুটির যোগান পরে স্বাভাবিক হলেও এই বিক্ষোভ স্তিমিত হয়নি, বরং রাজনৈতিক অভিমুখ পেয়ে গেছিল।

পরের দিন বিকেলে শহরের দখল নিল সামরিক বাহিনী, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করল তুরিন শহরের কেন্দ্রে। শহরের বাইরে তখনও লুঠপাট এবং ব্যারিকেড গড়া অব্যাহত। বোর্হো সান পাওলো, যেখানে সমাজতন্ত্রীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল, সেখানে বিক্ষোভকারীরা ভাঙ্গচুর চালায় এবং সান বের্নার্দিনো চার্চে আগুন লাগিয়ে দেয়। পুলিশ নির্বিচারে জনগণের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। সংঘর্ষ তীব্রতর হয় ২৪শে অগাস্ট। সকালে বিক্ষোভকারীরা শহরের কেন্দ্র দখল করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। কয়েক ঘণ্টা বাদে নির্বিচারে মেশিনগান ও সামরিক গাড়ি থেকে গুলি চালাতে শুরু ক’রে পুলিশ। শেষপর্যন্ত ২৫ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয় এবং বন্দী হন প্রায় ১৫০০ মানুষ। পরেরদিন সকালেও ব্যারিকেডহীন অবরোধ চলল। তারপরেই, ২৪ জন সমাজতন্ত্রী নেতা গ্রেপ্তার হলেন। স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ দমিত হল।

এই দিনগুলোতে ‘ইল গ্রিদো দেল্‌ পোপোলো’ প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়নি।  সমাজতন্ত্রী নেতা মারিয়া গিউদিস গ্রেপ্তার হওয়ার পরে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে গ্রামশির সম্পাদনায় পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে পত্রিকাটি। রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় বিদ্রোহের কোনো খবরই প্রকাশ হতে পারে নি পত্রিকায়। গ্রামশি এই সুযোগে লেনিনের একটা সংক্ষিপ্ত তথ্যসূচী প্রকাশ করলেনঃ “কেরেনস্কি ঐতিহাসিক ক্ষতির প্রতিনিধিত্ব করেন আর লেনিন করেন সমাজতন্ত্রী হয়ে ওঠার প্রতিনিধিত্ব। আর, আমরা সোৎসাহে লেনিনের সাথেই আছি।” এটা ছিল রাশিয়ার জুলাই মাসের দিনগুলোর ইঙ্গিত এবং পরবর্তীতে বলশেভিকদের রাজনৈতিক অনুশীলন। এর জন্যেই লেনিনকে ফিনল্যান্ডে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল।

কয়েকদিন বাদে সেপ্টেম্বর ১৫ তারিখে যখন জেনারেল লাভর কর্নিলভের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী পেট্রোগ্রাডের বিদ্রোহীদের দমন করে ক্ষমতা পুনর্দখল করে, তখন গ্রামশি আরো একবার উল্লেখ করলেন, “বিবেকের মধ্যে ঘটা বিপ্লব”সেপ্টেম্বর ২৯ তারিখে লেনিন আবার আখ্যায়িত হলেন, “বিক্ষুব্ধ বিবেক, ঘুমন্ত সত্তার জাগনঘণ্টা’ বলে। ইতালিতে তখনও অবধি রাশিয়া থেকে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ পৌঁছচ্ছিল না; একমাত্র ‘আভান্তি’তে প্রকাশিত জুনিয়রের অনূদিত কিছু খবর ছাড়া। এমতাবস্থায় গ্রামশি স্থির বিশ্বাসে সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী ভিক্টর চের্নভকে অভিহিত করছিলেন, “একমাত্র মানুষ যাঁর পরিকল্পনা আছে এবং সেই পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক। কোনোরকম জোট বরদাস্ত করে না। পরিকল্পনাটি যেহেতু ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধিতা করে তাই কখনোই বুর্জোয়াদের পছন্দ হবে না; এটাই সমাজবিপ্লবের শুরুর ধাপ।”

ইতালিতে রাজনৈতিক সংকট তখনো চলছিল। ১২ই নভেম্বর কাপোরেত্তোর যুদ্ধে ইতালির সৈন্যবাহিনী পরাজিত হওয়ার পরে ফিলিপ্পো তুরাতি ও ক্লদিও ত্রেভেসের নেতৃত্বে সংসদীয় সমাজতন্ত্রীরা বিগত সময়ের নিরপেক্ষ অবস্থান ভুলে খোলাখুলি জাতীয়তাবাদী অবস্থান নেন এবং ‘ন্যাশনালিজম’-এর স্বপক্ষে সওয়াল শুরু করেন। ‘ক্রিতিকা সোশিয়াল’-পত্রিকায় তুরাতি ও ত্রেভেস একটি প্রবন্ধ লেখেন যেখানে দেশের আভ্যন্তরীণ সনকটকালে প্রলেতারিয়েতদের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, পার্টির রক্ষণশীল-বিপ্লবীরা এই নতুন পরিস্থিতিতে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করে। নভেম্বরে এই নেতারা ফ্লোরেন্সে একটি গোপন মিটিং আয়োজন ক’রে “পার্টির ভবিষ্যৎ অভিমুখ” বিষয়ে আলোচনা করতে। গ্রামশি তখন পার্টির তুরিন শাখার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে এই মিটিং-এ প্রতিনিধিত্ব করেন। এই মিটিং-এ তিনি আমাদিও বোরদিগা ও তাঁর সমমনোভাবাপন্নদের সঙ্গে সহমত হন যে, জঙ্গি কার্যকলাপ করতে হবে। কিন্তু সেরাত্তি সহ অন্যরা সেই পুরনো নিরপেক্ষবাদী অবস্থানের পক্ষেই অনড় থাকেন। অধিবেশন সমাপ্ত হয় বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদ ও যুদ্ধবিরোধীতায় সহমত পোষণ ক’রে কিন্তু ভবিষ্যতের কর্মদিশা সম্বন্ধে রাজনৈতিক ধোঁয়াশা রয়েই যায়।

গ্রামশি তুরিনে ঘটা অগাস্ট মাসের ঘটনাবলীকে রুশ বিপ্লবের আলোকে বিশ্লেষণ করেন। গোপন অধিবেশন থেকে ফিরে সেই মুহূর্তে আরো সক্রিয় অংশগ্রহণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। এই আশাবাদে উদ্দীপিত হয়ে এবং বলশেভিক কর্তৃক রুশ দেশের ক্ষমতা দখলে উজ্জীবিত হয়ে ডিসেম্বরে একটি প্রবন্ধ লেখেন তিনি “লা রিভলিউজিওনে কন্ত্রো ‘ইল ক্যাপিতালে’ [‘পুঁজি’র বিরুদ্ধে বিপ্লব]” নামে। এই প্রবন্ধে গ্রামশি লিখলেন, “বলশেভিক বিপ্লব নিশ্চিতভাবেই সাধারণ রুশ জনগণের বিদ্রোহের ধারাবাহিকতা।” বিপ্লবকে আবদ্ধ গণ্ডি থেকে বের করে লেনিনের পার্টিজানেরা ক্ষমতায় এসে ‘তাদের একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করল এবং ‘বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সর্বসম্মত উন্নয়ন যাতে গতিশীল থাকে, তার সমাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’ বিস্তৃত করল। রুশ বিপ্লবীদের মধ্যে রাজনীতিগত মতানৈক্যের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা ১৯১৭ সালে গ্রামশির ছিল না। এর পাশাপাশি, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ব্যাপারে তাঁর মূল ধারণাগুলি কিছু সাধারণ ধারণার ওপরে ভিত্তি করে ছিল যেমন, এটা ‘হিংসাত্মক কোনো সংঘর্ষ ছাড়া’ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই সম্পন্ন হবে।

বলশেভিকদের বিপ্লব তাদের একাত্ম এবং অপ্রতিরোধ্য সাংস্কৃতিক শক্তির ভিত্তিতে ‘তথ্যসমূহের থেকেও অনেক বেশি আদর্শগত’ ছিল। এই কারণেই রুশ বিপ্লবকে শুধুমাত্র ‘মার্ক্সের লেখাপত্রের’ পাঠে বেঁধে ফেলা যাবে না। গ্রামশি লিখছেন, রাশিয়াতে ‘দাস্‌ ক্যাপিটাল’ “শ্রমিকদের থেকেও বেশি বুর্জোয়াদের বই” ছিল। গ্রামশি উল্লেখ করছেন  ১৮৬৭-র মুখবন্ধের প্রতি, যেখানে মার্ক্স দাবি করছেন উন্নত দেশগুলি অনুন্নত দেশগুলোকে পথ দেখাচ্ছে এবং প্রগতির ‘স্বাভাবিক স্তর’গুলোকে এড়ানো যাবে না। এই পাঠ্যের ভিত্তিতেই মেনশেভিকরা রাশিয়ার সামাজিক উন্নয়নের পাঠ তৈরি করছে যেখানে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আগে বুর্জোয়াসমাজ ও পূর্ণ বিকশিত শিল্পসমাজের প্রয়োজনীয়তা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু গ্রামশির মতে, লেনিনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীরা গোঁড়া মার্ক্সবাদী নন। কারণ, তাঁরা মার্ক্সের ‘অন্তর্নিহিত ভাবনা’ প্রত্যাখ্যান করেননি বরঞ্চ তাঁরা “দাস্‌ ক্যাপিটালের বেশ কিছু বক্তব্য ‘পরমমান্য ও অপরিহার্য সিদ্ধান্ত’ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন”।

গ্রামশির মতে, মার্ক্সের দাস্‌ ক্যাপিটালে লেখা পুঁজির বিকাশ বিষয়ক ধারণাগুলো সত্যি হতে পারত যদি ‘শ্রেণি অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা’র মধ্যে দিয়ে ‘জনপ্রিয় সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি’-র স্বাভাবিক বিকাশের পরিস্থিতি তৈরি হতো। কিন্তু যুদ্ধটা এরকম গতি পেয়ে গেছিল অপ্রত্যাশিত উপায়ে এবং রুশ শ্রমিকরা তিন বছরের মধ্যে এই প্রভাবের গভীরতা উপলব্ধি করেছিলেনঃ “উচ্চমাত্রার ব্যয়, ক্ষুধা ও ক্ষুধাজনিত মৃত্যু বেড়ে গেছিল এবং একধাক্কায় প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। [এর বিরুদ্ধে] প্রথম বিপ্লবের পরে স্বতঃস্ফূর্ততাগুলো সমস্বর হচ্ছিল প্রথমে যান্ত্রিকভাবে এবং পরে আবেগভরে।”

সম্মিলিত জনপ্রিয় ইচ্ছাশক্তি সমাজতান্ত্রিক প্রচারের ফলেই জেগে উঠছিল। রুশ শ্রমিকেরা এরকম ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে এক ধাক্কায় সমস্ত প্রলেতারিয়েত ইতিহাসকে জাগরিত করে তুলেছিলেন। শ্রমিকেরা তাঁদের পূর্বজদের প্রচেষ্টা হৃদয়ঙ্গম ক’রে ‘দাসত্বের বাঁধন’ থেকে মুক্ত হতে চাইছিল। তাদের মধ্যে ‘নব চেতনা’ দ্রুত জেগে উঠছিল যা ছিল “আগামী ভবিষ্যতের বর্তমান দ্রষ্টা”। সর্বোপরি, এই চেতনা জেগে উঠছিল সেই সময় যখন ইংল্যান্ডের মতো দেশে পুঁজিবাদ  আন্তর্জাতিকভাবে সর্বোচ্চ বিকাশে পোঁছেছিল। সম্মিলিত চেতনার আবশ্যিক শর্ত হিসেবে রুশ প্রলেতারিয়েতরা দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন।

‘ইল গ্রিদো দেল্‌ পোপোলো’-র তরুণ সম্পাদকের ওই ১৯১৭ সাল ছাড়া বলশেভিকদের ভাবনার বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না। ফলে সহজেই তিনি ট্রটস্কির ‘পার্মানেন্ট রেভ্যলুশন’ ধারণাটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। লেনিন এবং অন্যান্য বলশেভিকদের মধ্যে গ্রামশি দেখেছিলেন নিরবচ্ছিন্ন বিপ্লব প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রয়োগ। গ্রামশি ইতালিতেও এই বিপ্লব-ধারণাকেই বাস্তব করতে চাইছিলেন।

বিশ বছর বাদে ইতালির ফ্যাসিস্ত কারাগারে মারা যান গ্রামশি। ইতিহাসকে ফিরে দেখার এই প্রসঙ্গে হয়তো আমাদের মনে হবে যে, অক্টোবর বিপ্লবের গভীর প্রত্যাশাকে গ্রামশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। অথবা তাঁর ‘প্রিজন নোটবুকস্‌’ ছিল কোনো ‘নতুন ধারা’ খুঁজে বের করার চেষ্টা, যেখানে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথ আরো আপোষকামী ও নমনীয়।

কিন্তু, এরকম কোনো আত্মসমর্পণের কথা সেখানে নেই। গ্রামশি তাঁর জেলের লেখাপত্রে যে রাজনৈতিক তত্ত্বের কথা বলছেন, সেখানে শক্তি ও জনমতকে বিচ্ছিন্ন করে দেখছেন না। এই তত্ত্বে রাষ্ট্রকে দেখা হচ্ছে আভ্যন্তরীণ শক্তিগুলির পদ্ধতিকরণের ঐতিহাসিক ফলাফল হিসেবে এবং যে পদ্ধতিতে নিম্নবর্গীয় দলগুলোর প্রতিকূলতা আরো বেশি বেড়ে যায়। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সংগ্রামের সশস্ত্রতার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে লিখছেন গ্রামশিআর, একইসাথে, আধিপত্যকামী (Hegemonic) ঘনীভবন এবং রাজনৈতিক রূপান্তরবাদের (‘Transformism’) বিপদ সম্পর্কেও লিখছেন তিনি। জনপ্রিয় বাস্তবতায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, যা সদাসর্বদা বিপজ্জনক, সেই বিষয়টিকে গুরুত্বসহ অনুধাবন করেছিলেন গ্রামশি। তাঁর ‘অনুশীলনের দর্শন’ (Philosophy of praxis) লেখায় সর্বজনীন বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে মার্ক্সবাদের ক্রমপ্রসারণের প্রয়োজনীয়তার কথা লিখছেন তিনি।

আর তাই, তাঁর জেলবন্দী জীবন কোনোভাবেই এই ইঙ্গিত দেয় না যে, গ্রামশি রুশ বিপ্লবকে বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন শ্রমিকশ্রেণির মুক্তিসংগ্রামের কার্যকরী ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। রুশ বিপ্লব গ্রামশির হৃদয়ে চিরজাগরুক ছিল তাঁর জীবনের অন্তিমলগ্ন তথা ১৯৩৭-র এপ্রিল পর্যন্ত।

টীকাঃ

১। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়াতে ম্যাক্সিমালিস্ট হল সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী দলের একটি উপগোষ্ঠী। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রবক্তা এবং পার্লামেন্টারী ব্যবস্থার বিরোধী, এঁদের অনেকে ১৯১৭ সালে বলশেভিকদের সঙ্গে বা বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের সঙ্গে যোগ দেন। ইতালীর সময়াজতন্ত্রী দলের বামপন্থী অংশের নাম ছিল ম্যাক্সিমালিস্ট, এবং সম্ভবত এই কারণে গ্রামশির এই বিভ্রাট।

 

২। Hal Draper, Karl Marx’s Theory of Revolution, vol III, The ‘Dictatorship of the Proletariat’, -এ দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, মার্ক্স বা এংগেলস ঐ শব্দগুলি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্রের কোনো উল্লেখ করেন নি। 


Viewing all articles
Browse latest Browse all 214

Trending Articles